সকালে ঘুম থেকে উঠে অনেকেই পেট ফাঁপা, ভারীভাব বা গ্যাস্ট্রিকের অস্বস্তিতে ভোগেন। এই সমস্যাগুলোর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে হজমজনিত সমস্যা, হরমোনের তারতম্য কিংবা খাদ্যাভ্যাস। তবে একেবারেই অবহেলা করা হয় যে কারণটি, তা হলো রাতের খাবার। কী খেয়েছেন, কখন খেয়েছেন এবং কতটা খেয়েছেন— এই তিনটি বিষয়ের ওপর অনেকাংশেই নির্ভর করে আপনার পরদিন সকাল কেমন যাবে।
রাতের খাবার দিনের অন্যান্য খাবারের তুলনায় একটু বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে কারণ এটি আপনার দেহকে ঘুমের সময় সহায়ক ও ভারসাম্যপূর্ণ রাখতে সহায়তা করে। আমাদের পাচনতন্ত্র সারাদিনের ক্লান্তি শেষে রাতে ধীরগতিতে কাজ করে। অতএব, যদি রাতের খাবার ভারী বা হজমে কঠিন হয়, তবে তা সহজেই পেটের গ্যাস, ফোলাভাব, অস্বস্তি এবং এমনকি কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
রাতের খাবার যদি অতিরিক্ত মসলাদার হয়, যেমন ঝাল ভর্তা, তেলে ভাজা খাবার বা চর্বিযুক্ত মাংস, তবে তা পাকস্থলীতে দীর্ঘক্ষণ থেকে যায়। ঘুমের সময় হজম প্রক্রিয়া ধীর হয়ে যাওয়ায় এই ধরণের খাবার হজমে সমস্যা তৈরি করে। ফলে পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পেট ভারী, ঢেকুর, অ্যাসিডিটির মতো উপসর্গ দেখা দেয়। অনেকে ভাবেন, এগুলো শুধুই ‘গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা’। কিন্তু এর মূল উৎসটা রাতে কী খেয়েছিলেন, সেটাই।
বেশিরভাগ মানুষ রাতের খাবার খেতে খেতে টিভি দেখে বা ফোন ব্যবহার করে। এর ফলে তারা খাওয়া পরিমাণের ওপর মনোযোগ দিতে পারেন না এবং অজান্তেই অতিরিক্ত খেয়ে ফেলেন। এই অতিরিক্ত খাবার যখন হজম হয় না, তখন গ্যাস উৎপন্ন হয়। অনেক সময় রাতে দেরি করে খাওয়া হয়, যেমন রাত ১১টার পরে ডিনার করলে শরীরকে ঘুম ও হজম দুটোই একসাথে সামলাতে হয়। এতে হজম প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় এবং সকালে উঠে অস্বস্তি বোধ হয়।
পাশাপাশি, যারা রাতের খাবারে অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করেন। যেমন অতিরিক্ত ভাত, আলু, বা মিষ্টি জাতীয় খাবার, তাদের ক্ষেত্রে শরীর ইনসুলিন তৈরি করে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। এই প্রক্রিয়ায় হজম ধীর হয় এবং পেটে গ্যাস জমে। এছাড়াও, যারা খাবারের সঙ্গে বেশি ঠান্ডা পানি পান করেন, তাদের ক্ষেত্রেও হজমে সমস্যা হয়। ঠান্ডা পানি পাকস্থলীর পাচক এনজাইমগুলোর কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়।
রাতে যদি খুব তাড়াহুড়ো করে বা দাঁড়িয়ে খাওয়া হয়, তবে তাতে বাতাস পেটে ঢুকে যায়। এটি গ্যাস এবং ফাঁপা ভাবের কারণ হতে পারে। একইভাবে, যেসব খাবারে ফাইবার কম থাকে, যেমন পরিশোধিত চাল বা পোলাও, সেগুলো কোষ্ঠকাঠিন্যের ঝুঁকি বাড়ায়। পরদিন সকালে মলত্যাগে সমস্যা হলে পেট ভারী বা ফোলা অনুভব হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
আরও একটি বড় কারণ হলো রাতে কোনো প্রকার ফলমূল বা দুধ জাতীয় খাবার খেয়ে শুয়ে পড়া। অনেকেই মনে করেন, ঘুমানোর আগে এক গ্লাস দুধ স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। যদিও এটি আংশিক সত্য, তবে দুধ কারও কারও জন্য ল্যাকটোজ ইনটলারেন্সের সমস্যা তৈরি করতে পারে। এতে পেটে গ্যাস বা অস্বস্তি হয়। একইভাবে, সাইট্রাস জাতীয় ফল যেমন কমলা, আঙুর ইত্যাদি রাতের বেলায় খেলে অ্যাসিডিটির সমস্যা তৈরি হতে পারে।
চিন্তাভাবনা এবং মানসিক চাপও রাতের খাবারের হজমে প্রভাব ফেলে। মানসিক চাপের ফলে শরীর ‘স্ট্রেস হরমোন’ নিঃসরণ করে, যা হজমতন্ত্রকে ধীর করে দেয়। ফলে খাওয়া ঠিকঠাক হলেও হজমে সমস্যা হয় এবং পেট ফাঁপে। অনেকে আবার খালি পেটে ঘুমাতে যান, যা আরও বড় সমস্যা। দীর্ঘ সময় না খেয়ে ঘুমালে পাকস্থলীতে অ্যাসিড তৈরি হতে থাকে এবং সেটা গ্যাস ও পেটব্যথার কারণ হতে পারে।
এই সমস্যাগুলো প্রতিরোধে কিছু অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি। প্রথমত, রাতের খাবার হতে হবে হালকা এবং সহজপাচ্য। ভাতের বদলে রুটি, শাকসবজি, স্যুপ বা গ্রিলড মাছ/চিকেন খাওয়া যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, রাতের খাবার ও ঘুমানোর মাঝে অন্তত দুই ঘণ্টা ব্যবধান রাখা দরকার, যাতে হজমের জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যায়। তৃতীয়ত, খাবার খাওয়ার সময় ফোন বা টিভি এড়িয়ে সচেতনভাবে খাওয়া উচিত, যাতে অতিরিক্ত না খাওয়া হয়।
যাদের সকালে নিয়মিত পেট ফাঁপার সমস্যা হয়, তারা এক সপ্তাহ রাতে কী খাচ্ছেন, তার একটা নোট রাখতে পারেন। এতে বোঝা যাবে কোন খাবারগুলো সমস্যা তৈরি করছে। পাশাপাশি পানির পরিমাণ বাড়ানো, নিয়মিত হাঁটা এবং সময়মতো ঘুমানো হজমতন্ত্রকে সচল রাখতে সাহায্য করে।
অতিরিক্ত গ্যাসের সমস্যাকে সাধারণ ‘গ্যাস্ট্রিক’ ভেবে বারবার অ্যান্টাসিড খাওয়া ঠিক নয়। এটি কেবল সাময়িক স্বস্তি দেয়, কিন্তু সমস্যার মূল উৎস রাতের খাবারের অভ্যাস পরিবর্তন না করলে পেটের অস্বস্তি প্রতিদিনের সঙ্গী হয়ে উঠবে। তাই সচেতন হন, রাতের খাবারকে গুরুত্ব দিন। কারণ ভালো একটি সকাল শুরু হয় আগের রাত থেকেই।
Leave a Reply