এটি ছিল গাজা যুদ্ধবিরতি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা নেওয়ার আগেই তার দূত স্টিভ উইটকফের মধ্যস্থতায় গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্ভব হয় এবং হামাসের বন্দিদশা থেকে কয়েক ডজন জিম্মি মুক্তি পায়, যার বিনিময়ে ইসরায়েলি কারাগার থেকে শত শত ফিলিস্তিনি বন্দিকেও মুক্তি দেওয়া হয়।
পরবর্তী পর্যায়ে আরও জিম্মিকে দেশে ফিরিয়ে আনা এবং আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তির আগে গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনাদের ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করার কথা ছিল।
সংঘাতে ক্লান্ত ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিরা সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের সমাপ্তির কথা ভাবছিল। কিন্তু যুদ্ধ শেষ করতে চাননি নেতানিয়াহু।
তিনি গাজাজুড়ে আবার আক্রমণ শুরু করার নির্দেশ দেওয়ার সময় বলেছিলেন, হামাস “সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত” লড়াই চলবে।
গাজায় অবশিষ্ট জিম্মিদের নিরাপদে প্রত্যাবর্তনকে একটি গৌণ বিষয় বলে মনে হয়েছিল তখন। (গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের ওপর যে প্রভাব পড়েছে তা বিবেচনাতেই নেওয়া হয়নি)
অনেক ইসরায়েলি, বিশেষ করে জিম্মিদের পরিবারগুলো এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়।
তারা নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন যে তিনি তাদের স্বজনদের (যারা জিম্মি আছে) নিরাপত্তা এবং জাতির বৃহত্তর কল্যাণের চেয়ে নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্বকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
জরিপে দেখা গেছে, “বিবির” (নেতানিয়াহু এই নামেও পরিচিত) জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে এবং তিনি অতি-ডানপন্থি এবং তিনি গোঁড়া ধর্মীয় দলগুলোর কট্টর মন্ত্রীদের দ্বারা পরিচালিত একটি বিচ্ছিন্ন সরকারকে একত্রিত করতে লড়াই করছেন।
তিন মাস পর, নেতানিয়াহু তার শত্রুপক্ষ ইরানের বিরুদ্ধে এক অসাধারণ সামরিক বিজয়ের দাবির ওপর ভাসছেন। জানা গেছে, তিনি এখন আগাম নির্বাচন দেওয়া এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আরও একটি মেয়াদের কথা ভাবছেন।
গত সপ্তাহের শুরুতে এক সংবাদ সম্মেলনে, ৭৫ বছর বয়সী এই নেতা, যিনি ইতোমধ্যেই ইসরায়েলের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রধানমন্ত্রী, তিনি বলেছেন যে তার এখনো “অনেক মিশন” সম্পন্ন করা বাকি আছে এবং যতদিন ইসরায়েলের ‘জনগণ’ তাকে চাইবে ততদিন তিনি তা করতে চাইবেন।
সপ্তাহের শেষের দিকে এসে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করে দেওয়ার (যেটি এখনো নিশ্চিত নয়) দাবিকে একটি ‘সুযোগের জানালা’ হিসেবে উপস্থাপন করেন তিনি। এই সুযোগ “হাতছাড়া করা উচিত নয়” এবং কেবল তিনিই গাজা থেকে “জিম্মিদের মুক্ত করা এবং হামাসের পরাজয়” নিশ্চিত করতে পারবেন বলেও উল্লেখ করেছেন। বৃহত্তর আঞ্চলিক ঐকমত্যের ভিত্তিতেই এগুলো করতে পারবে বলে তিনি যুক্তি দেন।
কিন্তু আগাম নির্বাচন আহ্বান করা একটি বড় ঝুঁকি হবে এবং সাম্প্রতিক জরিপ অনুসারে, নেতানিয়াহু ইরানের সাথে ১২ দিনের সংঘাত থেকে জনপ্রিয়তায় যতটা ‘উল্লম্ফন’ আশা করেছিলেন ততটা উপভোগ করতে পারেননি।
ইসরায়েলের মা’আরিভ সংবাদপত্রে এই জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
এতে বলা হয়, ইসরায়েলি পার্লামেন্ট বা নেসেটের ১২০টি আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য জোট গঠন গুরুত্বপূর্ণ। আর বিদ্যমান ভঙ্গুর রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টি এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে যথেষ্ট পিছিয়ে থাকবে এবং ডানপন্থি ছোট দলগুলোর সমর্থন পেতে তাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হতে পারে।
একই জরিপে উল্লেখযোগ্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখানো হয়েছে যেখানে ৫৯ শতাংশ ইসরায়েলি চান যে জিম্মিদের বিনিময়ে গাজায় যুদ্ধ এখনই বন্ধ হোক।
উত্তরদাতাদের প্রায় অর্ধেক, প্রায় ৪৯ শতাংশ মনে করেছেন যে নেতানিয়াহু যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার একমাত্র কারণ তার নিজস্ব রাজনৈতিক বিবেচনা।
“লোকটি একজন অত্যন্ত দক্ষ রাজনৈতিক অভিনেতা,” বলেন ইসরায়েল ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউটের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো অধ্যাপক তামার হারম্যান। তিনি এটাও যোগ করেন, “ইসরায়েলে তার চেয়ে দক্ষ রাজনীতিবিদ আর কেউ নেই।”
কিন্তু তিনি এটাও বলেন, “বিশ্বাস” নেতানিয়াহুর জন্য একটি বড় সমস্যা।
ক্ষমতার লাগাম আঁকড়ে ধরার জন্য এত বার নিজের অবস্থান পরিবর্তন করেছেন এমন একজন রাজনৈতিক নেতাকে বেশিরভাগ ইসরায়েলিরা আর বিশ্বাস করে না।
অধ্যাপক হারম্যানের ইসরায়েল ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউট শিগগিরই প্রকাশ করবে এমন এক নতুন জরিপের তথ্য হলো, নেতানিয়াহু “ইসরায়েলিদের পূর্ণ বা আংশিক আস্থা অর্জনের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশের সীমা অতিক্রম করেননি”।
এই তথ্য জানিয়ে অধ্যাপক হারম্যান বলেন, কিছু দিক থেকে আগাম নির্বাচনের ঘোষণা “ইরান আক্রমণের চেয়েও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ (নেতানিয়াহুর জন্য), কারণ মধ্যপ্রাচ্যে আপনি সত্যিই জানেন না যে ছয় মাসের মধ্যে আপনি কোথায় থাকবেন।”
কারণ, ইরানে তার সামরিক জুয়াখেলা আপাতদৃষ্টিতে সফল মনে হলেও নেতানিয়াহুর বসার ঘরের কোণে একটি হাতি রয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, আপনি বলতে পারেন যে হাতিদের ছোট একটি দল তার আরও একটি মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার আশাকে মাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে।
নেতানিয়াহু আগামী সপ্তাহে ইসরায়েলের আদালতে একটি হাই-প্রোফাইল ফৌজদারি মামলায় সাক্ষ্য দেবেন যেখানে তিনি ঘুষ ও জালিয়াতির অভিযোগের মুখোমুখি হচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যস্ত সময়সূচি এবং (ইরান যুদ্ধের সময়) বিশেষ জরুরি অবস্থার কারণে হাইকোর্টে তার শুনানি বিলম্বিত করার প্রচেষ্টা গত সপ্তাহের শেষে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল।
নেতানিয়াহু এবং তার সমর্থকরা বারবার তার বিরুদ্ধে আইনি মামলাটিকে ‘রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু দেশটিতে ক্রমাগত মেরুকরণ বাড়ছে এবং তার বিরোধীরা আরও জোরালো দাবি তুলছেন যে তাকে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত।
“বিবির” আইনি ঝামেলা সম্পর্কে দেরিতে জানতে পেরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, নেতানিয়াহু একজন “মহান নায়ক” এবং “যোদ্ধা” যার বিচার “অবিলম্বে বাতিল” করা উচিত অথবা, অন্ততপক্ষে তাকে ক্ষমা করা উচিত।
এখানে মনে রাখা উচিত, এই একই মার্কিন প্রেসিডেন্ট মাত্র কয়েকদিন আগে প্রকাশ্যে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে অপমানজনকভাবে নিন্দা করেছিলেন, কারণ ইরান যুদ্ধবিরতি চুক্তি শুরু হওয়ার আগেই তা ভেঙে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিল।
কিন্তু নেতানিয়াহুর বিচারের বিষয়ে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক হস্তক্ষেপকে ইসরায়েলের অনেকেই ‘অযৌক্তিক’ এবং ‘অকেজো’ বলে বর্ণনা করেছেন।
বিরোধীদলীয় নেতা ইয়ার ল্যাপিদ বলেছেন যে ট্রাম্পের “একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের আইনি প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়”।
অধ্যাপক হারম্যান বলেন, ইসরায়েলের প্রতি ট্রাম্পের স্পষ্টতই পরস্পরবিরোধী অবস্থান এবং নেতানিয়াহুর আইনি মামলায় হস্তক্ষেপের চেষ্টা “আমাদের সাথে একটি ব্যানানা রিপাবলিকের মতো (এমন একটি দুর্বল, দুর্নীতিগ্রস্ত ও অস্থিতিশীল দেশকে বোঝাতে এই শব্দ দুটি ব্যবহার করা হয় যেটি আর্থসামাজিকভাবে অন্য বিদেশি প্রভাবশালী শক্তির ওপর নির্ভর করে) আচরণ করার” শামিল।
অনেক ইসরায়েলির অভিযোগ, নেতানিয়াহু গাজায় যুদ্ধকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে দীর্ঘায়িত করে ইসরায়েলের বৈশ্বিক অবস্থান এবং এর অর্থনৈতিক সম্ভাবনার ক্ষতি করছেন। যদিও অনেক প্রাক্তন জেনারেল বলেছেন যে ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী বা আইডিএফ গাজায় সামরিকভাবে যতটা সফলতা পাওয়া সম্ভব ততটাই অর্জন করেছে।
এটাও ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এখনো গাজায় যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করেছে, যেখানে হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধে ৫৫ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।
নেতানিয়াহু এবং গ্যালান্টের সাথে ইসরায়েলের সরকার দৃঢ়ভাবে অভিযোগগুলো প্রত্যাখ্যান করে আসছে।
বেশিরভাগ ভাষ্যকারের মতে, গাজায় যুদ্ধ চলতে থাকা এবং ইসরায়েলি জিম্মিদের বন্দি অবস্থায় ইসরায়েলে নতুন নির্বাচনের কথা কল্পনা করা কঠিন হবে।
কিন্তু নেতানিয়াহুর অনেক সমালোচক এবং বিরোধী বছরের পর বছর ধরে তাকে অকালমৃত্যুর মুখোমুখি করেছেন এবং অবশ্যই তার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে তা কখনই অনুমান করতে পারছেন না।
Leave a Reply